Back
সাল: ১৯২৭

বাবা তারকনাথের আশীর্বাদধন্য পূণ্যভূমি তারকেশ্বরের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা এই বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ইতিহাস জানতে একটু অতীতে ঘুরে আসা যাক। এই বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে বাবা তারকনাথের মন্দির। এই এস্টেটের আনুকূল্যেই আমাদের বিদ্যালয়ের প্রাণস্পন্দন। তাই মন্দিরের কথা প্রসঙ্গে বলতে গেলে আমাদের ফিরে যেতে হয় সুদূর অতীতে। তৎকালীন বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ’র (১৭১৭-১৭২৭) আমলে, অযোধ্যার নবাবের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে ক্ষত্রিয় ভূ-স্বামী কেশব হাজারী, তাঁর দুই পুত্র বিষ্ণুদাস ও ভারামল্ল এবং অনুচরসহ তারকেশ্বরের নিকটবর্তী রামনগর গ্রামে উপস্থিত হন। নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ’র আনুকূল্যে বিষ্ণুদাস রামনগরের জমিদার তথা রাজা হন। ভারামল্ল সাধক হলেও পরবর্তীতে ইনিও রাজা হন। ‘হুগলী জেলার ইতিহাস’ গ্রন্থের ৮২৩ পৃষ্ঠায় গ্রন্থাকার সুধীরকুমার মিত্র মহাশয় উল্লেখ করেছেন। ‘রাজা ভারামল্ল রায় প্রদত্ত তারকেশ্বরের সেবার জন্য ছাড়পত্রটি তারকেশ্বরের মোহান্তের প্রসিদ্ধ মামলার পেপার বুক হইতে শ্রী জহরলাল বসু তাঁহার ‘বাঙলা পদ্য সাহিত্যের ইতিহাস’-এ প্রথম বাঙলা গদ্যের নমুনা হিসেবে উদ্ধৃত করিয়াছেন।’ সেই ছাড়পত্রের হুবহু উদ্ধৃতির মধ্যে স্বাক্ষর অংশে শ্রী রাজা ভারামল্ল রায়’ কথাটি উল্লেখ আছে। বিষ্ণুদাস ও রাজা ভারামল্ল এই দুই ভাই-ই প্রথম তারকেশ্বর মন্দির নির্মাণ করেন। এই মত বহু প্রচলিত। যদিও তৎকালীন পূজ্যপাদ মোহান্ত মহারাজ বিদ্যালয় হীরক জয়ন্তী স্মারক ‘চরৈবেতি’-তে মন্দির উৎকীর্ণের সময়কাল হিসেবে ১৫৪৩ শকাব্দের উল্লেখ করেছেন। এ বিষয়ে নানা মতান্তর থাকলেও কালগত সুক্ষ্ম বিচার না করে বলা যায় একাধিক শতাব্দী পূর্বে এই তীর্থের প্রকাশ ও প্রচার ঘটেছে। পূণ্যভূমি এই তীর্থের ছত্রছায়ায় লালিত আমাদের এই বিদ্যালয়। বিভিন্ন সামাজিক, ধর্মীয়, অর্থনৈতিক পরিস্থিতির পথ পেরিয়ে এই মন্দির পরিচালনার কাজ করে গেছেন দোদন্ড প্রতাপশালী সব মোহান্তগণ। যার মধ্যে গিরি সম্প্রদায় উল্লেখযোগ্য। তৎকালীন সময় যখন দেশজুড়ে অসহযোগ আন্দেলন চলছে তার আঁচ এসে পড়েছিল। এই মন্দিরে। মোহান্তের বিরুদ্ধে শুরু হওয়া বিদ্রোহের জয় সূচিত হলো। সতীশচন্দ্র গিরি – উত্তর ভারতীয় গিরি সম্প্রদায়ের শেষতম প্রতিনিধির অবসান ঘটলো। তারকেশ্বর এস্টেটের রিসিভার নিযুক্ত হলেন শ্রী অমূল্যচন্দ্র ভাদুড়ী মহাশয়। তৎকালীন সময়ে ইনি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে এম.এ. পাশ করেন। চা-বাগিচা শিল্পে কর্মরত বাঙালীদের মধ্যে ইনি ছিলেন অগ্রগণ্য। উল্লেখ পাওয়া যায় শ্রী অমূল্য চন্দ্ৰ ভাদুড়ী মহাশয়ই ১৯২৫ সালে এই বিদ্যালয় স্থাপন করেন। তবে এই বিদ্যালয় স্থাপনের আগে থেকেই একটি বিদ্যালয় চালু ছিল। ১৯২২ সালে (সম্ভবত) সেটি জুনিয়র হাইস্কুলে উন্নীত হয়। শ্রীরামপুরের মাহেশ থেকে আগত শ্রদ্ধেয় ক্ষেত্রপতি চট্টোপাধ্যায় মহাশয় তারকেশ্বর মধ্যে আশ্রয় নেন। তাঁরই অদম্য উৎসাহে তৎকালীন মোহান্ত মহারাজের আনুকূল্যে বিদ্যালয়টি স্থাপিত হয়েছিল। বিদ্যালয় জমিটির উত্তর পশ্চিম কোণে রাজবাটীর দক্ষিণ দিকের গেটের সংলগ্ন স্থানে। তখন বিদ্যালয়টির নাম ছিল ‘তারকনাথ বিদ্যালয়’। তৎকালীন সময়ে বাঁকুড়া নিবাসী চন্দ্রশেখর দত্ত মহাশয়, প্রধান শিক্ষক হিসাবে নিযুক্ত হন। আটজন সহকারী শিক্ষক নিয়ে তিনি এই বিদ্যালয় পরিচালনা করতেন। ১৯২৫ সালের ১৫ই নভেম্বর, বিদ্যালয় ইতিহাসের এক উল্লেখযোগ্য দিন। তারকেশ্বর এস্টেটের রিসিভার শ্রদ্ধেয় অমূল্যচন্দ্র ভাদুড়ী মহাশয় ‘তারকনাথ বিদ্যালয়’-এর আর্থিক ঘাটতি পূরণের ইচ্ছা জ্ঞাপন করায় এবং বিদ্যালয়টি যাতে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন লাভ করতে পারে সেজন্য সমস্ত মানুষকে উদ্যোগী হবার জন্য অভিভাবক ও বিদ্যোৎসাহীগণের এক সভা আহ্বান করতে তৎকালীন প্রধান শিক্ষক মাননীয় চন্দ্রশেখর দত্ত মহাশয়কে নির্দেশ দেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান শিক্ষক উক্ত তারিখে একটি সভা আহ্বান করেন।

বিদ্যালয়ের তৎকালীন কার্যকরী সমিতি কার্যত সচল না থাকায় উক্ত সভায় নিম্নলিখিত ব্যক্তিগণকে নিয়ে কার্যকরী সমিতি গঠিত হয়।

১। শ্রী অমূল্যচন্দ্র ভাদুড়ী (রিসিভার সভাপতি, জেলাশাসক সভাপতি পদ গ্রহণে অসম্মত হওয়ায় ইনি সভাপতি হন)
২। শ্রী প্রমথনাথ সান্যাল শাস্ত্রী (রিসিভার ব্যক্তিগত সহকারী সম্পাদক)
৩। শ্রী চুনীলাল তা (অভিভাবক প্রতিনিধি)
৪। শ্রী এককড়ি চরণ মুখোপাধ্যায় (আইনজ্ঞ)
৫। শ্রী নরেশচন্দ্র দত্ত (শিক্ষক প্রতিনিধি)
৬। শ্রী চন্দ্রশেখর দত্ত (প্রধান শিক্ষক)
৭। শ্রী পূর্ণচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় (অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক)
৮। মুন্সী আবদুল রবি মল্লিক
৯। শ্রী মনোহর দে

১৯২৫ সালে কার্যকরী সমিতির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নিবনির্মিত বিদ্যালয় উদ্বোধনের দিন ধার্য করা হয় ১৯২৭ সালের ২১শে ডিসেম্বর। এই উদ্বোধন অনুষ্ঠানের সভাপতি হওয়ার সম্মতি জানান বর্ধমান ডিভিশনের কমিশনার এ ডল্যু কুক্ (আই.সি.এস)।

১৯২৭ এর ১৬ই সেপ্টেম্বর কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভায় গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ‘অ্যাসিস্ট্যান্ট রেজিস্টার’ তার ২৬.৯.১৯২৭-এর পত্রে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে জানান বিদ্যালয়টিকে আপাতত একবছরের জন্য অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। উপরোক্ত অনুমোদন পত্রের শর্তানুযায়ী নতুন পরিচালক মন্ডলী গঠিত হয় এবং ১লা জানুয়ারী ১৯২৮ থেকে ‘স্কুলকোড অনুযায়ী বিদ্যালয় পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ১৯২৪ সালে বিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু। সে সময় বিদ্যালয়ের নাম ছিল ‘তারকনাথ বিদ্যালয়’। অনুমোদন লাভের পূর্বে ১৯২৭ সালের প্রথমেই পরিচালক মন্ডলীর সভায় বিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করে ‘তারকেশ্বর হাই ইংলিশ স্কুল’ নামকরণ করা হয়। ২১.৯.১৯৫৫ তারিখের পরিচালন সমিতির সভায় কার্য বিবরণী থেকে জানা যায়। যে, মাধ্যমিক পর্যদের নির্দেশ অনুযায়ী ‘ইংলিশ’ শব্দটি বাদ দিয়ে বিদ্যালয়ের নাম “তারকেশ্বর উচ্চ বিদ্যালয়’ হয়েছে। ১৯২৫ সালের ২৯শে নভেম্বর তারিখে অনুষ্ঠিত পরিচালক মন্ডলীর সভায় ‘ইউ’ আকৃতিক দক্ষিণ মুখো বিদ্যালয় ভবন নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ১৯৮৪ সালে অনুষ্ঠিত হীরক জয়ন্তী অনুষ্ঠান উপলক্ষে প্রকাশিত ‘স্মারকগ্রন্থ’ ‘চরৈবেতি’তে তৎকালীন সম্পাদক লিখেছেন যে, প্রায় ৪৫ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছিল বিদ্যালয় ভবন নির্মাণে।

১লা জানুয়ারী ১৯২৮ থেকে ‘স্কুল কোড’ অনুযায়ী বিদ্যালয় পরিচালনার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় বলে এবং ‘ইংলিশ স্কুল’ নামকরণের পরিপ্রেক্ষিতে ইংরেজি নববর্ষের ১লা জানুয়ারী বিদ্যালয় ছুটির প্রচলন থাকায় ২রা জানুয়ারী প্রতিষ্ঠা দিবস রূপে গণ্য করা হয়েছিল।
আংশিক সময়ের অনুমোদন তো চলছিল, বিদ্যালয়ের সরকারী পূর্ণ অনুমোদনের জন্য ১৯২৫ সালের পর থেকে দীর্ঘ বছর ধরে নানান প্রক্রিয়া, পরিচালন কমিটি পরিবর্তন, পরিমার্জন, বিভিন্ন বিষয় পর্যালোচনা ও একটার পর একটা পদক্ষেপ পার করে ১৫.৭.১৯৫১ তারিখের সভায় জানানো হয় যে, তারকেশ্বর এস্টেটের পক্ষে রিসিভার শ্রী অমূল্যচন্দ্র ভাদুড়ী মহাশয় স্কুল গৃহ, গৃহ সংলগ্ন মাঠ ও স্কুলের অন্যান্য সম্পত্তি মাননীয় হুগলী জেলা জজের অনুমোদন যুক্ত যে দলীল (Under Taking) দ্বারা বিদ্যালয়ের পরিচালন সমিতিকে অর্পণ করেছেন (Vest) কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সেই দলীলের শর্তাবলী গ্রহণ করেছেন বলেই অনুমোদন (অস্থায়ী) পাওয়া যাচ্ছে। অবশেষে মধ্যশিক্ষা পর্ষদ ২৮.৯.৫৯ তারিখের OR 12152G / 807252 নং পত্রে জানান যে, ১.৪.৫৯ থেকে পুনরাদেশ না দেওয়া পর্যন্ত বিদ্যালয়ের অনুমোদন বহাল থাকবে, সেই নির্দেশ বলবৎ আছে।

উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের ৮.৭.১৯৭৬ তারিখের 2396/Recog নম্বর পত্রে বিদ্যালয়টি উচ্চমাধ্যমিক বিভাগ (একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণিযুক্ত) খোলার অনুমোদন লাভ করে। অবশ্য প্রতি ২ বছর অন্তর অনুমোদন নবীকরণ করতে হয়।

বিভিন্ন পালা পরিবর্তনের পট পেরিয়ে এগিয়ে চললো আমাদের বিদ্যালয়। পুরোনো ভবনের পাশাপাশি, বিদ্যালয়ের উত্তর মুখে নির্মিত হলো এক নতুন ভবন। সময়টা ২০০০ সাল। এই ভবন নির্মাণে তারকেশ্বরবাসী, শুভানুধ্যায়ী, শিক্ষকমন্ডলী, ছাত্র-ছাত্রীদের অবদান অনস্বীকার্য।

আজ এই একবিংশ শতাব্দীর নতুন সূর্যের আলো গায়ে মেখে, আধুনিক সভ্যতার অঙ্গণে দাঁড়িয়ে আমরা মাথা উঁচু করে গর্ব করি আমাদের শিক্ষাঙ্গণকে নিয়ে। যদিও অনেক ঘাত প্রতিঘাত ও পালা পরিবর্তন ঘটেছে। ক্ষণে ক্ষণে বদলেছে রূপ, বিদ্যালয় অঙ্গণ আজ নবরূপে সজ্জিত। বাবা তারকনাথের আশীর্বাদ ও সকল শুভানুধ্যায়ের আস্তরিক সহযোগিতায় বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা আজ শৃঙ্খলাপরায়ণতায়, পড়াশোনায়, খেলাধূলায়, সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল নির্মাণে, মেধা অন্বেষণের সাফল্যে বিদ্যালয়কে সুনাম ও শ্রীবৃদ্ধির শিখরে পৌঁছে দিয়েছে। আমাদের বিদ্যালয় আজ আপন গরিমায় ভাস্বর। আগামী দিনে আমাদের, আপনাদের এই বিদ্যালয় আরও উন্নতির শিখর স্পর্শ করবে, আপনি, আমি, আপনাদের সকলের আশীর্বাদ ও শুভকামনাকে পাথেয় করে।

তথ্য সংকলন ও লেখনী: শ্রীযুক্ত সঞ্জয় মজুমদার (প্রধান শিক্ষক, তারকেশ্বর উচ্চ বিদ্যালয়),
শ্রীযুক্ত চন্দন হালদার (সহকারী শিক্ষক, তারকেশ্বর উচ্চ বিদ্যালয়) এবং সকল শিক্ষক-শিক্ষিকা-শিক্ষাকর্মিবৃন্দ

সম্পাদনা: Pinaki Mondal (M.Tech, IIT, Kharagpur)


References and further readings: